সাভার সংবাদদাতা:
সাভারে পিতা আব্দুস সাত্তারকে হত্যা করে ৯৯৯-এ ফোন করে আত্মসমর্পণ করেছেন মেয়ে। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে নাটোরের সিংড়াতেও। নিজ মেয়ের হাতে নিহত আব্দুস সাত্তার নাটোরের সিংড়া থানার ভগা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রশিদের ছেলে।
বাবা-মেয়ের মধ্যকার দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন, মামলা পাল্টা মামলার ইতিহাস এবং শেষ পর্যন্ত একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সমাজের গভীর অসুস্থতাকেই তুলে ধরছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সাভার পৌর এলাকার মজিদপুরে ‘নূর মোহাম্মদ ভিলার’ পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন আব্দুর সাত্তার ও তার একমাত্র মেয়ে। বৃহস্পতিবার (৮ মে) ভোরে মেয়েটি প্রথমে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বাবাকে অচেতন করেন। পরে রাত আনুমানিক ৪টার দিকে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে নিজেই ৯৯৯-এ কল দিয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানান।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং মেয়েটিকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে। সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জুয়েল মিঞা বলেন, “আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।”
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১৯ সাল থেকে বাবার বিরুদ্ধে মেয়েটি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছিলেন। ২০২৩ সালে নাটোরের একটি আদালতে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন তিনি। অন্যদিকে আব্দুর সাত্তারও তার বিরুদ্ধে চুরির পাল্টা মামলা করেন। এরপর তারা আলাদা বসবাস শুরু করলেও গত কয়েক মাস আগে মেয়েটি বাবার কাছে ফিরে যান। এরপর থেকেই বাবার পক্ষ থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে মেয়েটি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
সিংড়ার ভগা গ্রামের এই ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্থানীয়রা জানান, সাত্তার দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে থাকতেন। তবে গ্রামের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল সীমিত। অনেকে হতবাক যে, একমাত্র মেয়ের হাতে একজন পিতা নিহত হলেন। কেউ কেউ আবার বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন।
এক প্রতিবেশী বলেন, “সাত্তার সাহেব খুব বেশি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে মিশতেন না। তবে যে এমন ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাও করিনি।”
সামাজিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “এটা শুধু পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়, সমাজে পরিবারভিত্তিক সহিংসতা, মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার প্রতিচ্ছবি। যদি মেয়েটির অভিযোগ সত্য হয়, তবে এ ঘটনার দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। আবার অভিযোগ অসত্য হলে, সেটিও ভয়ঙ্কর এক উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করা একটি বেসরকারি সংগঠনের এক কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশে অনেক নারী যৌন সহিংসতার শিকার হলেও সামাজিক লজ্জা ও প্রমাণের অভাবে নীরবে সহ্য করেন। অনেকেই শেষ পর্যন্ত চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।”
সিংড়ার সন্তান সাত্তারের হত্যাকাণ্ড কেবল একক পারিবারিক কলহের ফল নয়, বরং এটি সমাজের বিচারহীনতা, পারিবারিক সহিংসতা ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। ঘটনাটি যেই ঘটাক, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে সুস্থ সম্পর্ক, আইনি সহায়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব এখন আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক।
Leave a comment