Monday , 28 April 2025
Home রাজশাহী বিভাগ জাতীয় র‍্যাবের অভিযানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সদস্য আটক
জাতীয়রাজশাহী বিভাগ

র‍্যাবের অভিযানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সদস্য আটক

রাজশাহী সংবাদদাতা:

“ভাই, আমাকে ওরা মারবে, কিছু একটা করেন।”
লিবিয়ার এক অজ্ঞাত বন্দিশালা থেকে ভিডিওকলে কাঁদছিলেন কুড়িগ্রামের ইয়াকুব আলী। তার পাশেই আরো ২৬ বাংলাদেশি যুবক। তাদের চেহারায় হতাশা, চোখে শুধুই ভয়। পরিবারে ফোন করে টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে দেহ ফেলে দেওয়া হবে মরুভূমিতে।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় র‍্যাব-৫-এর গোয়েন্দা নজরদারিতে শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ৩টায় রাজশাহীর হড়গ্রামে র‍্যাব সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বেরিয়ে আসে মানবপাচারের এক ভয়ংকর চক্রের মুখোশ। গ্রেফতার করা হয়েছে এই চক্রের মূলহোতা নওগাঁর জাহিদ হোসেনকে, যিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন ইতালিপ্রবাসী ব্যবসায়ী হিসেবে।

র‍্যাবের প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলার ২৭ জন যুবককে ‘ইতালিতে বৈধ চাকরির’ প্রলোভনে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে অর্থ আদায় করে চক্রটি।

প্রধান অভিযুক্ত জাহিদ হোসেন ও তার দুই সহযোগী এহরাম সরদার ও বাবু মোল্লার সহায়তায় কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলার দরিদ্র তরুণদের টার্গেট করেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে অগ্রিম ৪-৫ লাখ টাকা নেয়া হয়। বাকিটা পৌঁছার পর পরিশোধের শর্তে চুক্তি হয়। তাদেরকে জানানো হয় তাদের ফ্লাইট ইতালি যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো।

ভুক্তভোগীরা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে রওনা হন। দুবাই হয়ে পৌঁছান নাইজার। এখান থেকেই শুরু হয় বিভীষিকাময় যাত্রা। সড়কপথে নিয়ে যাওয়া হয় আলজেরিয়ায়, যেখানে স্থানীয় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং দীর্ঘ ২১ দিন জেলে রাখে।

সেখানে থেকে বেরিয়ে ফের দালালদের নিয়ন্ত্রণে পড়েন তারা। তিউনিশিয়া হয়ে অবশেষে পৌঁছান লিবিয়ায়। সেখানে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন, সন্ত্রাস আর মুক্তিপণের খেলা।

প্রেস ব্রিফিংয়ে র‍্যাব জানায়, বন্দিদের বিবস্ত্র করে ছবি ও ভিডিও পাঠানো হতো পরিবারের কাছে। ভয় দেখিয়ে দাবি করা হতো ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। একজন ভুক্তভোগী ইয়াকুব আলীর পরিবার বিকাশ, নগদ ও বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ টাকা পাঠান চক্রের দেওয়া নম্বরে। আরেকজনের পরিবার দেয় ৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে শুধু এই একটি অপারেশনেই ৪০ লাখ টাকা আদায় করে চক্রটি।

কেউ টাকা দিতে না পারলে চলত আরও বীভৎস নির্যাতন। ভুক্তভোগীদের হাত-পা বেঁধে পেটানো হতো, খেতে দেওয়া হতো না, ভিডিও কলে কান্না শব্দ শোনানো হতো পরিবারের ওপর।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার পর কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলা হয় ২৫ মার্চ ২০২৫। মামলা নম্বর ১৭/২৫, ধারা, ৪০৬/৪২০/৩৬৫/৩৬৮/৩৮৬/৩৮৭/৩৪। এরপরই তদন্তে নামে র‍্যাব।

র‍্যাব-৫-এর কমান্ডার লে. কর্নেল ফজলে রাব্বী খান ব্রিফিংয়ে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার হাজীনগর থেকে বৃহস্পতিবার রাতে জাহিদ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পাচারের কাগজপত্র, টাকা লেনদেনের রশিদ, ব্যাংক একাউন্ট ডিটেইলস ও মোবাইল ফোন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ নিজের দোষ স্বীকার করেছে এবং চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম জানিয়েছে। তবে এখনো বিদেশে থাকা বেশ কয়েকজন সক্রিয় সদস্য অধরা।

র‍্যাব আরো জানায়, এই চক্র শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রয়েছে তাদের দালাল ও সহযোগীরা।

নাইজার, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও লিবিয়ায় বিভিন্ন ‘ড্রপ পয়েন্ট’ রয়েছে, যেখানে পাচারকারীরা সমন্বয় করে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে বন্দিশালা পরিচালনা করে। ভুয়া ভিসা, জাল রুট এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় বিদেশি সংযোগ।

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, “এই চক্রটি শুধু মানবপাচার করে না, বরং মুক্তিপণ আদায় ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে বড়সড় অর্থনৈতিক জাল গড়ে তুলেছে। বহু মানুষ নিখোঁজ, বহু পরিবার নিঃস্ব।”

র‍্যাবের মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য পেয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস (লিবিয়া) দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। দূতাবাসের সহায়তায় লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে ২৭ জনকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়। তারা দেশে ফিরেছেন গত জানুয়ারি মাসে। তবে এদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, এখনো ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

ভুক্তভোগী ইয়াকুব বলেন, “আমি ভাবিনি কখনো দেশের লোকজন এভাবে প্রতারণা করতে পারে। ৫ মাস লিবিয়ায় বন্দী ছিলাম, মার খেয়েছি, পানি পর্যন্ত দেয়নি। এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না।”

র‍্যাব জানিয়েছে, চক্রের অন্যতম সদস্য এহরাম সরদার ও বাবু মোল্লাকে ধরতে অভিযান চলছে। একই সঙ্গে দেশের বাইরে থাকা সংযোগসূত্রগুলো চিহ্নিত করার জন্য ইন্টারপোল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস এমএফএস) এর মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

র‍্যাব-৫ কমান্ডার প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র মানুষদের টার্গেট করে এই চক্র। তাই পরিবারের সদস্যদের উচিত প্রলোভনে না পড়ে বিদেশ যাওয়ার আগে বিস্তারিত যাচাই করা।’

এছাড়া তিনি জানান, পাচার রোধে গণমাধ্যম, সচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—সবকিছুর সমন্বয় প্রয়োজন।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Categories

Related Articles

সারাদেশরাজশাহী বিভাগ

বিলুপ্তির পথে বদলগাছীর পুখুরিয়া জমিদার বাড়ির “গোপাল মন্দির”

নিজস্ব প্রতিবেদক: নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলা ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামের হিন্দু পাড়ায় অবস্থিত...

সারাদেশরাজশাহী বিভাগ

গাবতলীতে মডেল থানা পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ৫

বগুড়া সংবাদদাতা: বগুড়ার গাবতলী মডেল থানার পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৫ আসামীকে...

সারাদেশরাজশাহী বিভাগ

সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা

নিজস্ব প্রতিনিধি: রাজশাহীর দূর্গাপুর উপজেলায় শাহবুদ্দিন ও ইসরাফিল নামে দুইজন গণমাধ্যম কর্মীসহ...

সারাদেশরাজশাহী বিভাগ

সাংবাদিকের বাড়িতে বিএনপি নেতার হামলায় আহত ৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: নওগাঁর মান্দায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা সাংবাদিক রায়হান আলীর বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে...