নিউজ ডেস্ক:
কালু খাঁ, মোল্যা তমিজদ্দিন কিংবা রাঙ্গা মিয়াদের কথা। যাঁরা নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রতিবাদ করায় যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন। ২০০ বছর আগের সেই বাড়ি থেকে কি জানা যায়? যে বাড়ির প্রতিটি ইটের সাথে মিশে আছে সেই নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের গল্প।
কালু খাঁর বাড়ি ছিল কালিয়ার গাজীরহাট গ্রামে। তমিজদ্দিনের বাড়ি বাঐসোনা গ্রামে। আর রাঙ্গা মিয়া থাকতেন মধুপুর গ্রামে। এ রকম আরও কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রাণী আর নীলকরেরা!
নড়াইলের প্রাচীন স্থাপনা রাণী রাশমণি এস্টেটের কাচারিবাড়ি হতে পারে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র। নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার নড়াগাতি থানার অন্তর্গত জয়নগর ইউনিয়নের নড়াগাতি নামক গ্রামে রয়েছে রাণী রাশমণি এস্টেটের কাচারি।
কালিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলােমিটার পূর্ব দিকে নড়াগাতি নামক গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামের নড়াগাতি বাজারের সাথে লাগােয়া দক্ষিণ দিকে নড়াগাতি বাঐসােনা পাকা সড়কের পশ্চিম পাশে রাণী রাশমনি এস্টেটের কাচারি বাড়ির অবস্থান।
জনশ্রুতি রয়েছে, রাণী রাশমণি তাঁর জমিদারি মকিমপুর থেকে কালিয়ার নড়াগাতিতেও বিস্তার করেন। নড়াগতি বাজার সংলগ্নে অবস্থিত প্রাচীন কাচারি বাড়িটি রাণী রাশমণি এস্টেটের কাচারি বাড়ি হিসেবে স্থানীয় লােকজনের কাছে সুপরিচিত।
এটিকে আবার অমৃতনগর জমিদারির কাচারী নামে অনেকে উল্লেখ করেন। রাণী রাশমণি এস্টেটের কাচারি বাড়ির মাঝখানে একতলা বিশিষ্ট ১ টি ভবন রয়েছে । কাচারি ঘর হিসেবে পরিচিত এ ভবন থেকে প্রায় ৬.৫ মিটার পূর্ব দিকে ১ টি কালী মন্দির , প্রায় ৯ মিটার দক্ষিণ দিকে ধ্বংসাবশেষের ১ টি টিবি এবং প্রায় ৩৫ মিটার উত্তর পূর্ব দিকে একটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে।
তৎকালীন যশোর জেলার মকিমপুর পরগনাটি শাসন করতেন রাণী রাশমনি। আর নড়াইলের নড়াগাতিসহ কালিয়া উপজেলার জমিদার ছিলেন শিশির কুমার রায়। এই নড়াগাতিতেই ১৮১২ সালে রাণী রাশমনি নির্মাণ করিয়েছিলেন কাছারিবাড়ি আর মন্দির। কাছারি বাড়িটি ছিল ৪ একর ৪৯ শতক জমির ওপর, ৮০ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া। বাড়িটির পাশেই ছিল আঠারবাকি নদী। কাছারি বাড়িটি ছিল কারুকার্যমণ্ডিত।
নির্মাণের সালটি দেখলেই বুঝতে পারবেন, সেটা ব্রিটিশদের উপনিবেশকাল। প্রজা নির্যাতনের নৃশংসতা ছিলো তখন ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। আরও কর, আরও খাজনা আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল ইংরেজ বেনিয়ারা। নীল চাষের ভয়াবহতায় তখন রচিত হচ্ছে কালো ইতিহাস।
সাধারণ মানুষ কষ্ট সহ্য করে যায়, কখনো ফুঁসে ওঠে। আর মানুষ ফুঁসে উঠলেই অত্যাচারীরা কঠোর হয়। ১৯১৫ সালে কাছারির অদূরে কালিয়া উপজেলার গ্রামগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে নড়াগাতি থানা। এই থানা কাছারির নায়েব, পাইক-পেয়াদা আর নীলকরদের নিরাপত্তা দেবে।
রাণীর কাছারির নায়েবের নাম শশীভূষণ। কর আর খাজনা আদায়ের জন্য শশীভূষণ ঝাঁপিয়ে পড়তেন প্রজাদের ওপর। এই বাড়িটি থেকে ভেসে আসত অত্যাচারিত কৃষক-প্রজাদের চিৎকারের শব্দ। ইংরেজরাও পিছিয়ে ছিলনা। তারা কাছারিবাড়ির আশপাশেই স্থাপন করেছিল ১২টি নীলকুঠি। প্রজা নির্যাতন বাড়তে থাকল।
শুরুতে যে তিনজনের নাম বলা হলো, তাঁদের মরদেহ কি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল? কিংবা তাঁরা ছাড়াও আরও যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের লাশ কি পেয়েছিল পরিবারের মানুষেরা? যতদূর জানা গেছে, তাঁদের নির্যাতনে হত্যার পর মরদেহ গায়েব করে দিতেন শশীভূষণ ও তাঁর পাইক-পেয়াদারা।
এখন কাছারিবাড়িটির বেহাল দশা। বাড়িটির দরজা-জানালাসহ বহু মূল্যবান জিনিসপত্রই চুরি হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার জন্য প্রহর গুনছে বাড়িটি। বেহাল দশা পাশের মন্দিরটিরও। রোদ-বৃষ্টিতে গরু-ছাগলের আশ্রয়স্থল হয়ে পড়েছে কাছারিবাড়িটি। বাড়িটিকে টিকিয়ে রাখা দরকার ইতিহাসের স্বার্থে। মানুষ জানবে, কোনো একদিন কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতো এই এলাকায়।
কাচারি বাড়ির দক্ষিণাংশে বিদ্যমান ধ্বংসাবশেষের ঢিবিটি রয়েছে। ঢিবিটির আয়তন প্রায় ৪৫০ বর্গ মিটার। এ ঢিবিটি পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১ মিটার উঁচু। সম্ভবত এ ধ্বংসাবশেষের ঢিবিটি তৎকালে নীলকরদের নীল প্রক্রিয়াজাত করণের স্থান বা নীল জাগের হাউজ ছিল।
এ জায়গায় প্রায় ৬০ সে.মি. পুরু দেয়ালের অংশবিশেষ দেখা যায়। তাই স্থানীয় লোকজনের দাবী নড়াইল জেলায় কালিয়া উপজেলার প্রাচীন স্থাপনাটি অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাগুলিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘােষণা করে সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হলে পর্যটকদের কাছে হতে পারে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাস রক্ষার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তরের জন্য স্থানীয় জনগণ আবেদন করেছে।
উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস মিয়া জানিয়েছেন, সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত কাছারিবাড়িটি ও জমির বিষয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
কালিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাড়িটি সংরক্ষণসহ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
বাড়িটি রক্ষা করা হলে ইতিহাসটা উঠে আসবে আবার। মানুষ জানতে পারবে, কোনো একদিন এই কাছারি বাড়িটি ছিল অত্যাচারের সাক্ষী। ইতিহাসই ওর হয়ে কথা বলবে।
Leave a comment