কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা:
কুড়িগ্রামে ৭৬টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই চালু রয়েছে। প্রশাসনের একাধিক অভিযান, জরিমানা ও বন্ধের নির্দেশ সত্ত্বেও এসব ভাটার কার্যক্রম থেমে নেই। ফলে একদিকে যেমন ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে জলজ প্রাণী ও বাস্তুতন্ত্র।
জেলার ১০৮টি ইটভাটার মধ্যে ৭৬টিরই নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র। অভিযোগ রয়েছে, এসব ভাটার অনেকগুলোই গড়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবসতির কাছাকাছি, যা সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নে তিন বছর আগে গড়ে ওঠা ‘মেসার্স এম আর বি ইকো ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর একাধিকবার অভিযান চালায়। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় অবকাঠামো, আদায় করা হয় ৩ লাখ ৫০ হাজার ও পরে ৫ লাখ টাকা জরিমানা। চলতি বছরও আবার অভিযান চালিয়ে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এসবই থেকে গেছে কাগজে-কলমে। সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, এখনো দাপটের সঙ্গে চলছে ভাটার কার্যক্রম।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ভাটার ধোঁয়ার কারণে আম, কাঁঠাল, লিচুসহ মৌসুমি ফলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ধানও সঠিকভাবে ফলছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক অভিযোগ করেন, “ভাটার ধোঁয়ায় ধানপালা পুড়ে যাচ্ছে। অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি, বরং উল্টো ভাটার মালিক আমার জমির একাংশ দখল করে নিয়েছে।
জেলা সদর, নাগেশ্বরী, রাজারহাটসহ বিভিন্ন উপজেলায় ফসলি জমির উপরিভাগ কেটে ইট তৈরি করা হচ্ছে। একসময় মাছ ও ধানের জন্য বিখ্যাত রাজারহাটের ‘গর্ভের দোলা’ এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে সাতটি অবৈধ ইটভাটা। স্থানীয় কৃষক রাসেল মিয়া বলেন, “গত কয়েক বছরে জমির ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এবার গ্যাসে ধান পুড়ে গেছে। ক্ষতিপূরণও মেলে না।”
নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভপুর দাখিল মাদ্রাসার পাশে চলছে ‘এস আর ব্রিকস’ নামে একটি ভাটা। মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, “ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত সর্দি, কাশি, চোখ জ্বালাসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। শিক্ষা অফিসকে জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
কুড়িগ্রাম জেলা পরিসংখ্যান অফিস জানায়, জেলার ৯টি উপজেলায় অনুমোদনহীন ইটভাটার সংখ্যা ৭৬টি। এর মধ্যে উলিপুরে রয়েছে ১৭টি, নাগেশ্বরীতে ১৫টি, সদর উপজেলায় ১৩টি, রৌমারীতে ৮টি, রাজিবপুর ও ফুলবাড়ীতে ৬টি করে, ভুরুঙ্গামারী ও চিলমারীতে ৫টি করে এবং রাজারহাটে রয়েছে ১টি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৩৫টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে ৩৭টি ভাটা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদেশ মানা হয়নি।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “ইটভাটাগুলো ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একবার জমি নষ্ট হলে পুনরায় উর্বর হতে সময় লাগে কমপক্ষে পাঁচ বছর।”
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম দৃষ্টিকোন সংবাদ জেলা প্রতিনিধি কে জানান, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
এ বিষয়ে একাধিক ইটভাটা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Leave a comment