খান নাঈম,
বরগুনা প্রতিনিধি
শিক্ষার্থী এবং তরুণ-তরুণীদের আতঙ্কের অপর নাম ‘বরগুনা মিমি অ্যান্ড ক্রাশ কনফেশন’ নামে ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে নারীদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বরগুনায়।
নিজের পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা উন্মুক্ত করে পোস্ট করার কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া ঝুঁকিতে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। এসব কর্মকাণ্ডকে সাইবার অপরাধ উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, “Barguna Meme & Crush Confession” নামের ফেসবুক পেজটিতে ১৩ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে। পেজটি থেকে প্রতিদিন কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই ছবিসহ নাম-পরিচয় দিয়ে প্রেম নিবেদনের একাধিক লেখা পোস্ট করা হচ্ছে। যাদের নিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই বরগুনার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রী। বিশেষ করে মেয়েদের ছবি দিয়ে পরিচয় উন্মুক্ত করে পোস্ট করা হয় বিয়ে কিংবা প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে। অথচ যার ছবিসহ পোস্ট করা হচ্ছে তিনি ওই পোস্টের বিষয়ে কিছুই জানেন না।
সম্প্রতি বরগুনা কেন্দ্রীক পেজটির মাধ্যমে সামাজিকভাবে হয়রানির পরিমাণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। এ থেকে বেড়েছে হতাশা, নারী ও ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতা। এর মাধ্যমে অনেকে হচ্ছেন বুলিংয়ের শিকার। ফেসবুকের যোগাযোগমাধ্যমে প্রেম নিবেদনের এসব পোস্টের কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শহরে পরিবারসহ যেসব মেয়েরা থাকে তাদের পরিবারগুলো অনেক সময় এসব সমস্যা বুঝতে পারে। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের পরিবারগুলোকে এসব বোঝানো খুবই কঠিন। দিনশেষে অভিযোগের তীর যেন মেয়েদের দিকেই যাচ্ছে। মেয়েরা সবসময় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। নতুন সমস্যার নাম হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব পেজ। আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘কিছুদিন আগে বরগুনা বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে কেউ গোপনে ছবি তুলে এই পেজে পোস্ট করে। বিষয়টা জানাজানি হলে পারিবারিকভাবে নানান সমস্যার সম্মুখীন হই। আজকাল রাস্তাঘাটে বের হতেও ভয় লাগে।’
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) সাইবার বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলছে, “ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করাকে বলা হয় সাইবার বুলিং”। আর এই উত্ত্যক্ত করার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, খুদে বার্তা, গেমিং প্ল্যাটফর্ম বা মুঠোফোন।
বন্ধুসভা বরগুনা ইউনিটের উপদেষ্টা পর্ষদে সদস্য আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে টিনেজার যারা রয়েছে তাদের সতর্ক থাকা উচিত বেশি। আর অভিভাবকদের বলতে চাই, আপনারা নিজের সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে যত্নবান হবেন। কনটেন্ট বানানোর জন্য অনেকে বেমালুম ভুলে যায় সামাজিকতা। হঠাৎ টাকা কামানোর ধান্দায় নিজের স্বকীয়তা নষ্ট করছে অনেকেই। ‘বরগুনা মিম ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামে পেজটির বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ শোনা যায়, প্রশাসনকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছি।’
সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্বার এর কর্মী জান্নাতুল মীম বলেন, ‘কারো ছবি এভাবে অনুমতি না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে ইভটিজিং থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনুমতি ছাড়া নাম বা ছবি এসব পাবলিক প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করা হয়, যা পরবর্তীতে তাদের সামাজিক, পারিবারিক জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনের প্রতি এসবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি রইল।
মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একপ্রকার যৌন নিপীড়নের হাতিয়ার ‘ক্রাশ এন্ড কনফেশন’ এই পেজগুলো। একজন ছাত্রীর সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ হয়, সে যত স্ট্রং মানসিকতারই হোক না কেন; স্থির থাকতে পারবে না। আমাদের সমাজে তো আরও নয়ই! এখানে মেয়েদের সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে বললেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ বা অভিভাবকরাও তা বিনা বাক্যে সত্য মনে করে। ফলে ভুক্তভোগীর পক্ষে এ ধরনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়াটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।’
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ এর ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির পরিচিত তথ্য (পরিচিত তথ্য বলতে নাম, ছবি, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জন্মতারিখ, ফোন নাম্বার ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে) সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি উপধারা ২ অনুসারে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড বা ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
উক্ত আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত কাজটি আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহায়তাকারী ব্যক্তি সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ বিষয়ে বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবদুল হালিম বলেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগজনক এবং সাইবার ক্রাইমের অংশ। এ ব্যাপারে কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। পাশাপাশি এসব পেজ বন্ধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
Leave a comment