কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা:
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের কাগজিপাড়া গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে নিজের শিশু কন্যাকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন এক পিতা। পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মেয়েটির বাবা জাহেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে তার স্ত্রী মোর্শেদা বেগম ও ভাবি কহিনুর বেগমকে। আদালতে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জানা গেছে, শনিবার (১০ মে) গভীর রাতে মোঃ জাহিদুল ইসলামের (৪৫) কন্যা নবম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী জান্নাতি খাতুন (১৫), নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। পরদিন তার মরদেহ বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে একটি ভুট্টা খেতের পাশে পাওয়া যায়। খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, মেয়েটির মাথায় ছিল গুরুতর আঘাতের চিহ্ন।
পরবর্তীতে জান্নাতির চাচা মোঃ খলিল হক (৫৫) বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তার দাবি, দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ জমির প্রতিপক্ষরা রাতের আঁধারে জান্নাতিকে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে।

মামলাটি হাতে নিয়ে কুড়িগ্রাম থানার ওসি ও জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি চৌকস দল তদন্ত শুরু করে। মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ভিকটিমের পিতা মোঃ জাহিদুল ইসলামের সাথে প্রতিবেশী মজিবর গংদের মধ্যে ৩২ বিঘা জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে জাহিদুল ইসলাম তার স্ত্রী মোছাঃ মোর্শেদা বেগম (৩৮) ও ভাইয়ের স্ত্রী মোছাঃ শাহিনুর বেগম (৪৫) এর সহযোগিতায় নিজ কন্যা জান্নাতিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা রড ও দা দিয়ে জান্নাতির শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপায় এবং পরবর্তীতে মরদেহটি ভুট্টা খেতে ফেলে রেখে খরের গাদায় আগুন লাগিয়ে আলামত ধ্বংসের চেষ্টা করে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ভিকটিমের পিতা জাহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে এবং তার দেখানো মতে বাড়ির পাশের বাঁশঝাড় থেকে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হত্যায় ব্যবহৃত ২০ মি.মি. ব্যাসের ৩৩ ইঞ্চি লম্বা একটি লোহার রড এবং একটি দা উদ্ধার করা হয়।

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের মিডিয়া অফিসার ও ডিবির অফিসার ইনচার্জ বজলার রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, “আমাদের যৌথ টিমের দ্রুত ও পেশাদার তদন্তের ফলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মূল হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জাহেদুল ইসলাম ও তার ভাই খলিলের সঙ্গে প্রতিবেশী মকবুল পাটোয়ারির সঙ্গে গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। এছাড়া একই পরিবারের আরেক ভাই রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও তাদের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল।

রফিকুল অভিযোগ করেন, “জাহেদুল ও খলিল আমাদের নানা সময়ে মারধর করেছে, প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। ওরা বলতো, ‘আমাগো মারি ফেললে সন্দেহ হইব, তাই নিজের মেয়েকেই মাইরা গোষ্ঠীরে ফাঁসাইতে চায়।”
স্থানীয়দের দাবি, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে খলিল সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন এবং তার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তারা আরও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, খলিলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় রুহুল আমিন (উকিল) ও আব্দুল কাদেরও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকতে পারেন।
কুড়িগ্রাম সদর থানার (ওসি) বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত নৃশংস ও হৃদয়বিদারক। পিতার হাতে সন্তানের এমন মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। জাহেদুল হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন এবং তার দেওয়া তথ্যে হত্যায় ব্যবহৃত কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।”
গ্রেফতারকৃত ৩ আসামি মোঃ জাহিদুল ইসলাম, মোছাঃ মোর্শেদা বেগম ও মোছাঃ শাহিনুর বেগম সোমবার (১২ মে) তারিখে বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। মামলাটির তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
Leave a comment